
একজন সাংবাদিককে সবসময় কঠিনকে মোকাবিলা করতে হয়। প্রতিবেদন করতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হয় নানা রকমের প্রতিকূলতার। খবরের সন্ধানে দুর্গম পথ পেরিয়ে পিচ্ছিল পথে এগিয়ে যেতে হয়। তাই অনেকের কাছেই এই পেশা যেন জেনেশুনে বিষপান করার মতোই। একজন চিত্র সাংবাদিকের ক্ষেত্রে সেই পথ আরও দুর্গম, কঠিন৷ দৃশ্যকে লেন্সবন্দি করার টানে চির উন্নত শির নিয়েই লক্ষ্যভেদে নামতে হয় তাকে৷ সেই পেশা ও নেশার সন্ধানে গিয়েই তালেবান-আফগান বাহিনীর সংঘর্ষে আফগানিস্তানে নিহত হলেন রয়টার্সের পুলিৎজারজয়ী চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি।
১৯৮০ সালের ১৯ মে মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন দানিশ সিদ্দিকি। এখানেই মধ্যবিত্ত পরিবারে কাটে তার শৈশব। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া থেকে স্নাতক করেন অর্থনীতিতে। অনেক আগ্রহ নিয়ে স্নাতকের পাঠ শেষে মাস কমিউনিকেশনের একটি কোর্স করেন। এ সূত্রেই পরবর্তীতে চিত্রসাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি।
টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ২০১০ সালে বার্তাসংস্থা রয়টার্সে শিক্ষানবিশ চিত্রসাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। কর্মদক্ষতা দিয়ে অনায়াসেই সংস্থার প্রধান চিত্রসাংবাদিকের পদ অর্জন করেন দানিশ। এর ছয় বছরের মধ্যেই ছবি তোলার সুযোগ পান বিভিন্ন দেশে। ক্যারিয়ারের ঝুলিতে আলোচিত অনেক ঘটনাকেই ফ্রেমবন্দি করেন। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক ঘটনা কাভার করা এ সাংবাদিক ক্যামেরাবন্দি করেন আফগান ও ইরাক যুদ্ধের পাশাপাশি হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলন, ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ছবি, ২০১৯-২০ সালে হংকং প্রোটেস্টের চিত্র। বিশেষ করে ২০২০ সালে দিল্লির দাঙ্গায় দানিশের তোলা সেসব ছবি মিডিয়া জগতে আলোড়ন তোলে।
পাশাপাশি ভারতের কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন সংগ্রাম ও সুইজারল্যান্ডে আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন-যাপনও উঠে এসেছে। যেখানে ফ্রেমই শব্দ, সেখানে ছিল তার ‘শব্দহীন’ কীর্তি। ফলে রয়টার্স ছাড়াও তার এসব ছবি বিশ্বের বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রিকা, স্লাইড শো ও প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে করা সিরিজের জন্যে ২০১৮ সালে রয়টার্সের সাত সদস্যের যে আলোকচিত্রী দল পুলিৎজার জিতেছিলেন, তার মধ্যে থাকা দুই ভারতীয়র একজন ছিলেন দানিশ সিদ্দিকি। তারপর ৪০ বছর বয়সী পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী এই চিত্রসাংবাদিকের গল্প জেনে যায় সারা পৃথিবী। দানিশ সিদ্দিকিকে বিশ্বের সেরা চিত্রসাংবাদিকদের মধ্যে গণ্য করা হতো। সেই প্রেরণায় কাজ চলতে থাকে প্রতিদিন।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের প্রায় ৮৫ শতাংশ নিজেদের দখলে রয়েছে বলে জানিয়েছে তালেবানরা। আফগান প্রশাসন চাইছে তালেবানদের সরিয়ে ওই এলাকাগুলো পুনর্দখল করতে। এই নিয়ে ক্রমশ বাড়ছে আফগানিস্তানে তালেবানদের আধিপত্য। স্পিন বোলডাক এলাকার মূল বাজারের অংশটির দখল ফিরে পাওয়ার জন্যে আফগান স্পেশাল ফোর্স আক্রমণ চালাচ্ছিল। আরও সাংবাদিকদের মতোই নিজের কর্তব্য পালনের জন্যেই আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন দানিশ। আফগানিস্তানের বিভিন্ন জায়গার সংঘর্ষের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
রয়টার্সের সভাপতি মাইকেল ফ্রাইডেনবার্গ ও এডিটর-ইন-চিফ আলেসান্দ্রা গ্যাল্লোনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কভারেজের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন দানিশ। সম্প্রতি, নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির কয়েকটি ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার তালেবান জঙ্গিদের গুলিতেই গুরুতর জখম হয়েছিলেন তিনি। আহত অবস্থায় চিত্রসাংবাদিককে শিবিরে রেখেই আফগান সেনারা তালেবান-বিরোধী অভিযানে গিয়েছিলেন। এর মধ্যেই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। দানিশ প্রথমে রয়টার্সকে জানান তিনি আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় তার হাতে বিস্ফোরিত বোমা থেকে বের হয়ে আসা শ্র্যাপনেলের আঘাত লাগে। তিনি আঘাতের জন্যে চিকিৎসা নেন এবং পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরে দানিশ বাজারের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তালেবানরা আবারও আক্রমণ করে বলে জানান আফগান কমান্ডাররা। সে সময় তালেবানরা স্পিন বোলডাক এলাকা থেকে পিছু হটে।
আবারও হামলা হলো সেই শিবিরেই। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দানিশ সিদ্দিকির। বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাটিতে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী ও তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে একটি সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করার সময় তিনি মারা যান।
দিল্লির বাসিন্দা দানিশ সিদ্দিকি চিরতরে চলে গেলেন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে রেখে। কয়েক মাস আগেও দিল্লির দাঙ্গায় এক কিশোরের গুলি ছোঁড়ার ছবি তুলতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হয়েছিল দানিশের। সেবার কোনোরকমে বেঁচে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু-মিছিলের মধ্যেও আমি মানুষের মুখ খুঁজি’। তখনও জানতেন না, বছরের মধ্যেই তিনি নিজে নিস্পন্দ এক মুখে পরিণত হবেন।
Comments